মুক্তগদ্য- পরিহাস

পরিহাস
– পায়েল সাহু

 

 

লোকটার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা এসে দাঁড়ালো বেশ বড়ো একটা ঘরের দরজায়, মেয়েটাকে ঘরে ঢুকে দরজা আটকাতে বলেই লোকটা তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো অফিসে।ঘরটায় দুটো চৌকি পাতা, পাশাপাশি। বিরাট মোটা মোটা দুটো তোষক গুটিয়ে রাখা, পাশে ওয়াড় | বালিশ, পাশবালিশ, সেগুলোর ওয়াড়, চাদর স্তুপ করে রাখা। মেয়েটার সঙ্গে আনা বেশ কয়েকটা ব্যাগ, তাতে মা বাবার ভরে দেওয়া প্রচুর জিনিস।

তেইশ পেরোনো মেয়েটা ওই লোকটার মাত্র এক মাস আগে বিয়ে করা বৌ, সদ্য কলেজ পাশ করে কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছিলো….. আর এই ঘরটা ওই লোকটার অফিসের কোয়ার্টার |
মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে না, জীবনে প্রথমবারের জন্য সম্পূর্ণ একার চেষ্টায় মোটা তোষকগুলো খুলে ওয়াড় পরিয়ে পেতে ফেলে, চাদর পাতে, সুন্দর করে বালিশ সাজায় |
একটা একটা করে ব্যাগ খুলে জিনিস সাজাতে থাকে তার নতুন সংসারে, “সংসার” সেদিন হয়তো সে মানেটাও বুঝতো না শব্দটার। হয়তো সেই সুযোগটাই নিয়েছিল তার স্বামী, সমস্ত কাজেই হাত তুলে দিয়ে ওই ছোট্ট মেয়েটার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতো সমস্ত দায়িত্ব। এমন নয় যে স্বামী ভদ্রলোক জানতেন না যে মেয়েটি বাবা মায়ের একমাত্র ভীষণ আদুরে সন্তান, তার কোনো কাজ করার অভ্যাস নেই, সে কিছুই প্রায় জানে না, রান্নাটুকুও না, সব কিছু জেনেই তিনি বিয়ে করেছিলেন।
মেয়েটির বাবা মাও এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন কারণ ছেলেটি মেয়েটির থেকে বয়সে বেশ বড়ো, ভেবেছিলেন তাঁদের মেয়েকে সামলে রাখবে জামাই, যত্নে রাখবে।

অফিস ক্যাম্পাসে ঘর হওয়ায় স্বামী ভদ্রলোকটি যখন তখন চলে আসতেন তাঁদের নিজের ঘরে, না না নতুন বৌয়ের টানে নয়, খাবার খেতে, তার না কি ক্ষিদে পায় বারবার, সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি আতংকিত হয়ে পড়তো তার স্বামীর আচরণে, সারাদিনে কতবার কি কি রান্না করে তাকে খেতে দিতে হবে ভেবেই তার কান্না পেতো, readymade খাবার তার স্বামী খাবেন না, তাকে বেশ গুছিয়ে পরিবেশন করতে হবে। আর না দিলেই অপমানজনক কথা তার জন্য অপেক্ষা করতো, হ্যাঁ, যদিও বিয়ের বয়স মাত্র একমাস |

মেয়েটা ভাতের ফ্যান গালতে পারতো না, বেশিরভাগ দিন তার হাতে গরম ফ্যান, গরম ভাত পড়ে যেতো, বঁটি দিয়ে সবজি কাটতে পারতো না, তবু সময়ের মধ্যে ভাতের থালাটা তাকে সাজিয়ে দিতেই হতো।
“ভরা পেটে ফল ” তাই স্বামী ভদ্ৰলোকটি দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে পা নাচিয়ে বৌকে আদেশ দিতেন তাকে ফল কেটে দেওয়ার। অবাক লাজুক মেয়েটি চুপ করে দেখতো তার স্বামীর ব্যবহার, প্রায় প্রতিদিন আঙ্গুল কেটে রক্ত বেরিয়ে গেলেও জানতে দিতো না সে তার স্বামীকে। তার মনে পড়তো মায়ের কথা, যিনি ফল কেটে মেয়ের মুখের সামনে ধরে সাধাসাধি করতেন খাবার জন্য। নাহ, মেয়েটি ভুল করেও স্বামীর জন্য কাটা ফল নিজে খেতো না, নিজে নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস যে তার নেই, অবশ্য তাকে সাধবার কেউ ছিলোও না |
মাস তিনেক পর মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে, প্রচন্ড জ্বর আসে তার, সুদূর রাজ্য থেকে মেয়েটির বাবা গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন নিজের কাছে, মা বাবার সেবা যত্নে মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠলেও স্বামীর কাছে আর ফিরতে চায় না, আতংকিত হয়ে পড়ে, যদিও ভুল করেও কখনো প্রকাশ করেনা মা বাবার কষ্টের কারণে |
তবু “সংসার” ছেড়ে থাকতে নেই তাই মেয়েটিকে আবার ফিরতেই হয় তার আশ্রয়ে। গর্ভবতী হয়ে পড়লেও যেখানে তার স্বামী চিকিৎসা করাতে চান না লোকলজ্জার ভয়ে। হ্যাঁ ওনারা বিবাহিত, তবু সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী অন্তসত্ত্বা, লোকে কি বলবে! তাই ডাক্তারের কাছে না নিয়ে গিয়ে লোকটি মেয়েটিকে তার বাপেরবাড়িতে রাখতে আসেন।
“কাঁচা নাড়ি” পথের ধকল সহ্য করতে না পেরে রক্তপাত শুরু করে, নতুন জীবনের সব আশা নিস্প্রাণ হয়ে পড়ে।

মাঝখানে কেটে গেছে পনেরোটা বছর|

মেয়েটি এখন একটি সন্তানের মা। বিয়ের দু’ বছর পর গর্ভবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্বামী বিছানা আলাদা করে নিয়েছিলেন, সেদিনের সেই অল্পবয়সী মেয়েটির শারীরিক চাহিদার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবেই। শারীরিক দূরত্ব শুরু থেকেই ছিলো, এই ঘটনায় মানসিক বন্ধনটুকুও কেটে গেলো। পুরো গর্ভাবস্থায় ভুল করেও স্ত্রীকে সময় দেওয়ার ভুল করেননি ভদ্রলোক |
অবলা লাজুক মেয়েটির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আজ সেই মেয়েটি বেশ জাদরেল গিন্নী। ভয়ংকর তার গলার জোর। নিজের চাহিদা, ইচ্ছে কিভাবে পূরণ করে নিতে হয় এখন সে বেশ ভালোই জানে এখন। পরিস্থিতি তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। মানসিক শান্তি, শারীরিক তৃপ্তির জন্য সে এখন আর তার স্বামীর মুখাপেক্ষী নয় কোনোভাবেই।
গত দশ বছর আগেই তার সঙ্গে তার স্বামীর মানসিক বিচ্ছেদ ঘটেছে চিরতরে। পরিবর্তে সে শিখে নিয়েছে নিজের স্বামীকে ঘৃণা করতে, তাকে দমিয়ে রাখতে, শিখেছে দাপট দেখাতে |
সব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলো শুরুতেই, চেয়েছিলো নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে সাজাতে, পারেনি, পারেনি নিজের মায়ের চরম শাসনে। দুর্ব্যবহারে, মানসিক আশ্রয়হীনতায় ভুগতে ভুগতে একের পর এক পুরুষের কাছে খুঁজে গেছে শুধু ভালোবাসা, মানসিক আশ্রয়।
“সংসার”টা আজ সে নিখুঁত ভাবে করে, এতটুকু ত্রুটি নেই কোথাও, রকমারি রান্নায় সে এখন একাই একশো।

পাশের ঘরের বিছানায় লেপের ওয়াড় পরাতে পরাতে স্বামী ভদ্রলোকটি বলে ওঠেন, “খুব মুশকিলের ব্যাপার এটা, উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে।” মেয়েটি একবার উঁকি মেরে দেখে আসে পাশের ঘরে, স্মৃতির ঝলকানিতে তীব্র ঘৃণায় সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে মুচকি হেসে ফিরে যায় নিজের ঘরে, যেখানে শুধু মাত্র তার অধিকার, যেখানে সে তার সন্তানের সঙ্গে থাকে।

Loading

Leave A Comment